হরিদাস ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ (নির্য্যান)


 


নমামি হরিদাসং তং চৈতনং তঞ্চ তৎপ্রভুন
সংস্থিতমপি জনমূর্ত্তিন স্বানকে কৃত্বা ননর্ত্ত :।। 

........ চৈতন্য চরিতামৃত, একাদশ অধ্যায়, অন্ত্যলীলা

                    প্রথমেই বিশ্বের সকল ভক্তবৃন্দের চরণে জানাই ভক্তিপূর্ণ প্রণাম। শুরুতেই ভক্ত যবন হরিদাস ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ বর্ণনার আগে তাঁর জীবনি সংক্ষিপ্ত আকারে ব্যাক্ত করার চেষ্টা করি।কলারোয়া থানার অন্তর্গত সাতক্ষীরা জেলার কেড়াগাছি গ্রামে ১৪৪৯ খ্রীষ্টাব্দের অগ্রাহয়ন মাসে ভক্ত হরিদাস ঠাকুর জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম সুমতি মিশ্র এবং মাতার নাম গৌরীদেবী। হরিদাসের বয়স যখন দু'মাস সেই সময় পিতা সুমতি মিশ্র পরলোক গমন করেন। মাতা গৌরীদেবী স্বামীর চিতায় সহমরন বরণ করেন এবং ঠাকুর হরিদাস অনাথ হয়ে পরেন। শিশু হরিদাস ঠাকুরের লালন পালনে কেউ এগিয়ে না এলে পিতা সুমতি মিশ্রের বন্ধু চাষী হাবিবুল্লা কাজী দয়াবসত হয়ে এই হরিদাস ঠাকুরের দায়িত্ব গ্রহন করেন। হাবিবুল্লা কাজীর স্ত্রীর আদর যত্নে শিশু হরিদাস লালিত-পালিত হতে থাকেন। যবনের (মুসলমানের) ঘরে প্রতিপালন হবার জন্যই তাঁকে যবন হরিদাস বলা হয়। বাল্য থেকে কৈশরে পদার্পন করার পর হাবিবুল্লা কাজী তাঁকে গরু চরানোর কর্মে নিয়োগ করেন। হরিদাসের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর অন্তরে কৃষ্ণপ্রেম ভক্তির প্রবল আকর্ষণ অনুভব করতে থাকেন। যেখানেই হরিনাম সংকীর্ত্তণ হতো সেখানেই ছুটে যেতেন প্রভু হরিদাস।

                অন্তরে কৃষ্ণভক্তি হরিনামে প্রবল অনুরাগ দেখা দিল, তিনি সব সময় উচ্চস্বরে হরিনাম কীর্তন করতে লাগলেন। এমনি ভাবে চলতে থাকায় কাজীর দরবারে তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ গেল, কাজীর হুকুমে জল্লাদ হরিদাস ঠাকুরকে বাইশ বাজারে বেত্রাঘাত করে ঘুরালেও তাঁর হরিনাম বন্ধ করতে পারলো না। হরিনামের প্রতি একনিষ্ঠ অবিচল ভক্তি দেখে প্রত্যেকেই বিস্মিত স্তম্ভিত হলো। বিচারক কাজী সাহেবকে না জানিয়ে জল্লাদেরা অনুতাপ প্রকাশ করে মৃতপ্রায় ঠাকুর হরিদাসকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিলেন দিলেন। এরপর গঙ্গার জলে ভাসতে ভাসতে শান্তিপুরের ঘাটে আসেনএখানেই তাঁর দীক্ষা সম্পন্ন হয় এবং মহাপ্রভুর আদেশে নামপ্রচারের উদ্দেশ্যে তিঁনি বেনাপোলের জঙ্গলে (বর্তমান বনগাঁ ) আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। 

                জঙ্গলাকীর্ণ আশ্রমে হরিদাস ঠাকুর হরিনাম জপ সাধনে নিমগ্ন হন, তখন হরিদাস ঠাকুরের তিন লক্ষ বার হরিনাম জপের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পরতে থাকে। তার মধুর কন্ঠের হরিনামের আকর্ষনে দলে দলে ভক্ত ছুটে এল কুঠিরে। ভক্তের আগমনে সেই জঙ্গলাকীর্ণ আশ্রম পরিনত হলো মহাতীর্থ স্থানে। অত্যাচারী রাজা রামচন্দ্র খাঁ ঠাকুর হরিদাসের গুনগান সহ্য করতে না পেরে তাঁকে জ্যান্ত পুরিয়ে মারার ইচ্ছা বিফল হলে, হীরানামক এক পতিতাকে দিয়ে তার সাধন, ভজন, যশ, খ্যাতি, ধর্ম নাশ করার চক্রান্ত করতে থাকে। সমস্ত চক্রান্তে ব্যর্থ হয়ে বার-বনিতা হীরা হরিনাম মহামন্ত্রে দিক্ষিত হয়ে হরিদাস ঠাকুরের পরম বৈষ্ণবী হয়ে যান। নামাচার্য্য শ্রী শ্রী হরিদাস ঠাকুর ছিলেন প্রকৃত বৈষ্ণবের জলন্ত উদাহরন এবং দৈন্যের অবতার। তিনি প্রতিদিন তিন লক্ষ বার হরিনাম জপ করে নামাচার্য্য নামে খ্যাত হন এবং ব্রহ্মত্ব অর্জন করেন।

হরিদাস ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ (নির্য্যান)

                ভক্ত হরিদাস ঠাকুর শ্রীচৈতন্য মহাপ্ৰভুর খুবই অনুরক্ত প্রিয় ছিলেন আদৰ্শ এক ভক্ত তিনি প্ৰত্যহ তিনলক্ষ হরিনাম জপ করতেন তাই মহাপ্রভুর অতি প্রিয়ভক্ত শ্রীরুপ শ্রী সনাতন পুরীতে থাকাকালীন হরিদাসের সঙ্গে থাকা পছন্দ করতেন কারণ তাঁর কুটীর ছিল বেশ নিৰ্জন স্থানে। হরিদাস ঠাকুরের সময় কাটত হরিনামে বা ভাগবত আলোচনায় অন্য কথায় তিনি কখনও নিজ জিহ্বা ব্যবহার করতেন না সকল ভক্তের হরিদাস ঠাকুরের উপর গভীর শ্ৰদ্ধা ছিল

            মহাপ্ৰভু প্ৰতিদিন সকালে জগন্নাথদেব দৰ্শনের পর সোজা চলে আসতেন হরিদাসের কুটীরে এবং কিছু সময় কৃষ্ণকথার পর নিজ বাসায় ফিরে আসতেন গোবিন্দকে দিয়ে তিনি প্রত্যহ হরিদাসের জন্য মহাপ্ৰসাদ পাঠিয়ে দিতেন। একদিন গোবিন্দ দাস, মহাপ্ৰসাদ নিয়ে এসে দেখেন হরিদাস ঠাকুর বিছানায় শুয়ে আছেন খুব মৃদুস্বরে হরিনাম জপ করে যাচ্ছেন ভক্ত গোবিন্দ বুঝলেন হরিদাসের শরীর সুস্থ নয় হরিদাস মাত্ৰ এককণা নিয়ে মহাপ্ৰসাদের সন্মান করলেন। ফিরে এসে ভক্ত গোবিন্দ মহাপ্রভুকে সব জানালেন।

                হরিদাসের এই অবস্থা জানাবার পর শ্রীচৈতন্য মহাপ্ৰভু তাড়াতাড়ি ছুটে এসে হরিদাসের স্বাস্থ্য সমন্ধে জিজ্ঞাসা করাতে, হরিদাস ঠাকুর ক্ষীণস্বরে উত্তর দিলেন , প্ৰভু, দৈহিকভাবে আমি তত অসুস্থ নই, তবে অন্তরে খুব কষ্ট অনুভব করছি কেননা আমার দৈনিক লক্ষ্য যে তিনলক্ষবার হরিনাম জপা, সে সংখ্যা পূৰ্ণ করতে পারছি না। মহাপ্ৰভু বল্লেন, ওহে প্রিয় হরিদাস, তুমি একজন পরমভাগবত ভক্ত, তুমি তো নাম সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছ তুমি তো হরিভজনের দৃষ্টান্তস্বরুপ হরিনামের মহিমা তো তুমি জগতে প্রচার করেছ সুতরাং তুমি হরিনামের সংখ্যা রাখতে পারছো কিনা সে বিষয়ে তো দুঃখ করার কিছু নাই। উত্তরে হরিদাস স্বভাবগত দৈন্য সহকারে বল্লেন, আমি আপনার অযোগ্যতম শিষ্য, তাই আমার অন্তরে একটা বহুদিনের বাসনা আছে, যদি আপনি কৃপা করে তা পূরণ করবেন কথা দেন তাহলে বলতে পারি। মহাপ্রভু বললেন, হে হরিদাস তুমি বলো, আমি অবশ্যই তোমার মনোবাঞ্ছা পুর্ন করব।

                কেঁদে কেঁদে হরিদাস ঠাকুর বললেন, হে স্বাতন্ত্র্য ঈশ্বর, হে আমার প্রভু, আমি যেন আপনার কমল চরণ পদযুগল বক্ষে জড়িয়ে ধরে, আপনার শ্ৰীমুখচন্দ্ৰ দৰ্শন করতে করতে, মুখে আপনার নাম নিয়ে আমি প্রাণ ত্যাগ করতে চাই কারণ আমি জানতে পেরেছি খুব শীঘ্ৰই আপনি লীলাসংবরণ করবেন আপনার সঙ্গে বিচ্ছেদ আমার পক্ষে অসহ্য হবে অতএব আমাকে এই বর দিন যেন আপনার অন্তর্ধ্যান আমাকে দৰ্শন না করতে হয়।

এই বাঞ্ছা হয় মোর বহুদিন হইতে। 
লীলা সম্বরিবে তুমি লয় মোর চিতে।। 
সেই লীলা প্রভু মোরে কভু না দেখাইবে। 
আপনার আগে মোর শরীর পড়িবে।। 

........ চৈতন্য চরিতামৃত, একাদশ অধ্যায়, অন্ত্যলীলা

                মহাপ্ৰভু শুধু মৃদু হাস্য হেঁসে চলে গেলেন সর্বজ্ঞ মহাপ্ৰভু পরদিন সকালে শ্ৰীদামোদর স্বরুপ, রায় রামানন্দ, সার্বভৌম ভট্টাচাৰ্য্য অন্যান্য কিছু অন্তরঙ্গ ভক্ত সঙ্গে হরিদাসের কুটীরে এলেন সংকীৰ্ত্তন শুরু করলেন; হরিদাসের ইচ্ছানুসারে তিনি ধ্যানমগ্নচিত্তে মহাপ্ৰভুর চরণ দুটি বুকে আকড়ে ধরে নয়নদ্বয়ের স্থির দৃষ্টি মহাপ্ৰভুর দেহের উপর নিবদ্ধ রেখে, ঠিক যেন দুইটি ভৃঙ্গ মধুপানে মত্ত, আহা, শ্ৰীকৃষ্ণনাম উচ্চারণ করতে করতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন

হরিদাস নিজাগ্রেতে প্রভুরে বসাইলা
নিজ নেত্র দুই ভৃঙ্গ মুখপদ্মে দিলা ।।
স্বহৃদয়ে আনি ধরিল প্রভুর চরণ। 
সর্ব্বভক্ত পদরেণু মস্তকে ভূষণ ।।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য শব্দ বলে বার বার
প্রভুমুখমাধুরী পিয়ে নেত্রে জলাধার ।।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নাম করিতে উচ্চারণ
নামের সহিত প্রাণ করিল উৎক্রামন ।।
মহাযোগেশ্বর প্রায় স্বছন্দে মরন (ইচ্ছামৃত্যু)
ভীষ্মের নির্য্যান সবা হইল স্মরণ ।।

........ চৈতন্য চরিতামৃত, একাদশ অধ্যায়, অন্ত্যলীলা

                আহা! কী গৌরবোজ্জ্বল প্ৰয়ান, পুরাকালের ভীষ্মের মহাপ্রয়াণ স্মৃতিকে জাগরিত করে সমবেত ভক্তমণ্ডলী মহাপ্রভুর উচ্চ নাম সংকীৰ্ত্তন সর্বত্র পূৰ্ণ হল। ভক্তবৃন্দ সবাই চোখের জলে বুক ভাসিয়ে কীর্ত্তন নৃত্য করতে লাগলেন।

"চতুর্দিকে ধ্বনি উচ্চারিত হইল, জয় হরিদাসের জয়, জয় মহাপ্রভুর জয়।"



                    মহাপ্ৰভু স্বরুপ দামোদর সহ অন্যান্য ভক্তবৃন্দ হরিদাস ঠাকুরের দেহটিকে তুলে নিয়ে এক সুসজ্জিত বিছানায় স্থাপন করলেন এবং স্বয়ং মহাপ্রভু হরিদাস ঠাকুরের দেহ সমুদ্রতীরে নিয়ে গেলেন। সেখানে সেই দেহটিকে সমুদ্রে স্নান করাইয়া কিছু ক্ৰিয়াকলাপের পর সমুদ্রতীরে একটা গৰ্ত্ত রচনা করিয়ে তার মধ্যে স্থাপন করলেন, তারপর দেহটিকে নুতন বস্ত্ৰ, পুস্প, চন্দন দিয়ে সাজিয়ে জগন্নাথদেবের মন্দিরের কিছু পবিত্ৰ সূত্ৰ স্থাপন করে, মহাপ্ৰসাদ অৰ্পণ করা হল তারপর মহাপ্ৰভু স্বহস্তে তাঁর উপর বালুকা দিলেন, অন্যান্যেরাও তাই করলেন হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করার মধ্য দিয়ে এবং একটি সমাধিস্তম্ভ রচনা করা হল। বৰ্তমানে স্থানটি পুরীর স্বৰ্গদ্ধারের নিকট হরিদাস সমাধি নামে খ্যাত এবং এক সমাধি মন্দির নিৰ্মিত হয়েছে। এখনও পুরীতে হরিদাস ঠাকুরের সমাধি মন্দিরে অখন্ড হরিনাম চলছে।

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে,
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।

No comments:

Post a Comment