মহাপ্রভুর ঝাড়িখণ্ডের পথে বৃন্দাবন গমন


 


শ্রীশ্রী চৈতন্য চরিতামৃত মধ্যলীলার সপ্তদশ পরিচ্ছেদ - 

গচ্ছন্ বৃন্দাবনং গৌরো ব্যাঘ্রেভৈনখগান বনে।
প্রেমোম্মত্তান সহোন্নত্যান বিদধে কৃষ্ণজল্পিন:।।

                    মহাপ্রভু বৃন্দাবনে যাইতে যাইতে বনের মধ্যে বাঘ, হাতি, হরিণ, ও পাখিদের শ্রীকৃষ্ণের নাম জল্পনায় প্রেমোম্মত্ত করাইয়া তাঁহার সহিত নৃত্য করাইয়াছিলেন।
জয় জয় গৌরচন্দ্র জয় নিত্যানন্দ। 
জয়াদ্বৈতচন্দ্র জয় গৌড় ভক্তবৃন্দ।। 

                একদা এক শরৎকালে মহাপ্রভু রায় রামানন্দ ও স্বরূপ দামোদরের নিকট নির্জনে যুক্তি করলেন, যদি তোমরা আমায় সহায়তা করো তাহলে আমি বৃন্দাবন দর্শনে যেতে চাই। রাত্রে উঠে বনপথে সত্ত্বর চলিয়া যাইব, কাউকে সঙ্গে নেব না। আর যদি কেউ আমার পিছনে যেতে চায়, তাঁহাকে বুঝাইয়া তোমরা রাখিয়া দেবে। তখন রায় রামানন্দ ও স্বরূপ দামোদর মহাপ্রভুকে বলিলেন হে দয়াময়! কৃপা করে একটি নিবেদন রাখুন। বলভদ্র ভট্টাচার্য্য নামধারী একজন পণ্ডিত, সাধু, ব্রাহ্মণ আছেন, উনাকে আপনার সাথে নিয়ে যান। 

ভিক্ষা করি ভিক্ষা দিবে যাবে পাত্র বহি ।।
বনপথে যেতে নাহি ভোজ্যান্ন ব্রাহ্মণ । 
আজ্ঞা কর সঙ্গে চলে বিপ্র একজন ।।
 
                অর্থাৎ গৃহস্থের বাড়ি থেকে ভিক্ষা করে এনে রান্না করে আপনার সেবা দেবে, জলপাত্রাদি বহন করে নিয়ে যাবে এবং সর্বোপরি এই গভীর বনপথে যে ব্রাহ্মণের হাত থেকে অন্ন সেবা নেওয়া যায়, তেমন ব্রাহ্মণ আর পাওয়া যাবে না। এছাড়া এই ব্রাহ্মণ শান্তিপুর থেকে আপনার সাথে আগমন করেছিলেন এবং উনার সর্ব্ব তীর্থ দর্শন করারও মনে অভিলাষ। তখন মহাপ্রভু তাঁহার কথা রাখলেন এবং বলভদ্র ভট্টাচার্য্যকে সঙ্গে নিলেন। 

পূর্ব্বরাত্রে জগন্নাথ দেখি আজ্ঞা লইয়া। 
শেষ রাত্রে উঠি প্রভু চলিলা লুকাইয়া ।। 
প্রাতঃকালে ভক্তগন প্রভু না দেখিয়া। 
অন্বেষণ করি ফিরে ব্যাকুল হইয়া ।। 

                এরপর প্রভু প্রধান চেনা পথ ছাড়িয়া ঝাড়িখণ্ডের বনপথের মধ্য দিয়ে এগোতে লাগিলেন। সেই উপপথে নির্জন বনের মধ্যে উচ্চস্বরে কৃষ্ণনাম করিতে করিতে আবেশে প্রভু চলিতে থাকিলেন। বনের অজস্র হিংস্র পশুরা (বাঘ, হাতি, গন্ডার, শূকরগন) পথ ছাড়ে প্রভুকে দেখিয়া। কিন্তু বলভদ্র ভট্টাচার্য্য ব্রাহ্মণের মনে ভয়ের উদ্ভব হয়। 

একদিন পথে ব্যাঘ্র করিয়াছে শয়ন । 
আবেশে তার গায়ে প্রভুর লাগিল চরণ ।। 
প্রভু কহে কহ কৃষ্ণ ব্যাঘ্র উঠিল। 
কৃষ্ণ কৃষ্ণ কহি ব্যাঘ্র নাচিতে লাগিল ।।
আর দিনে মহাপ্রভু করে নদীস্নান । 
মত্ত হস্তিযুথ এল করিতে জলপান ।। 
প্রভু জলকৃত্য করে, আগে হস্তী আইলা । 
কৃষ্ণ কহ বলি প্রভু জল ফেলি ধাইলা ।। 
সেই জলবিন্দুকণা লাগে যার গায় ।
সেই কৃষ্ণ কৃষ্ণ কহে প্রেমে নাচে গায় ।। 
পথে যাইতে যাইতে করে প্রভু উচ্চ সংকীর্তন । 
মধুর কণ্ঠধ্বনি শুনি আসে মৃগীগণ ।। 
কৃষ্ণ কৃষ্ণ কহ করি প্রভু যবে কৈল । 
কৃষ্ণ কহি ব্যাঘ্র মৃগ নাচিতে লাগিল ।। 
নাচে কুন্দে ব্যাঘ্রগন মৃগীগণ সঙ্গে । 
বলভদ্র ভট্টাচার্য্য দেখে অপূর্ব রঙ্গে ।। 
ময়ূরাদি পক্ষিগণ প্রভুকে দেখিয়া । 
সঙ্গে চলে কৃষ্ণ বলে নাচে মত্ত হইয়া ।। 
ঝাড়িখণ্ডে স্থাবর জঙ্গম আছে যত । 
কৃষ্ণ নাম দিয়া কৈল প্রেমেতে উন্মত্ত ।। 


                        বনপথ ছেড়ে প্রভু এরপর গ্রাম্য পথ ধরেন। যেই যেই গ্রাম দিয়া যান সেইসব গ্রামের মানুষের ভিতর প্রেমভক্তির উদ্ভব হয়, সবাই কৃষ্ণ হরি বলে হাঁসে, কাঁদে, নাচে গায়। সে এক অপূর্ব দৃশ্য, যার সাক্ষী বলভদ্র ভট্টাচার্য্য। শ্রীচৈতন্য গূঢ়লিলা কে বুঝিতে পারে? নাম-প্রেম দিয়ে সবাইকে প্রভু উদ্ধার করে নিচ্ছেন। অপরদিকে আবেশে প্রভুর কখনো বন দেখে বৃন্দাবন, নদী দেখে কালিন্দী আবার কখনো পাহাড় দেখে গিরি-গোবর্দ্ধন ভ্রম হয়। কখনো আবার প্রেমাবেশে মাটিতে ধুলায় গড়াগড়ি যায়। সে এক অদ্ভুত প্রেমভক্তি দর্শন করেছিলেন বলভদ্র ভট্টাচার্য্য, ধন্য জীবন তাঁর। তাঁহার চরণে শতকোটি প্রনাম। 
                    এরপর মহাপ্রভু কাশীতে উপস্থিত হলেন। সেখানে তপন মিশ্র ও মিশ্রের মিত্র-সখা ভক্ত চন্দ্রশেখরের সহিত মিলিত হইলেন।  তপন মিশ্রের অনুরোধে অনিচ্ছাসত্বেও দিন দশেক প্রভু বারাণসীতে অবস্থান করেছিলেন। অতঃপর প্রভু প্রয়াগে আসিয়াছিলেন।  সেস্থানে ত্রিবেণী ঘাটে (যমুনা ও স্বরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থল) স্নান করিয়াছিলেন। 

যমুনা দেখিয়া প্রেমে পড়ে ঝাঁপ দিয়া। 
আস্তে ব্যস্তে ভট্টাচার্য্য উঠায় ধরিয়া।। 
এই মত তিন দিন প্রয়াগে রাহিলা। 
কৃষ্ণনাম প্রেম দিয়া লোক নিস্তারিলা।। 
মথুরা নিকটে আইলা মথুরা দেখিয়া।
দণ্ডবৎ হইয়া পড়ে প্রেমাবিষ্ট হইয়া।। 

                        প্রভুর প্রেমভক্তির লীলা কেই বা বর্ননা করিতে সক্ষম হয়েন। শ্রীশ্রী চৈতন্য চরিতামৃতের পাতায় শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী যতটুকু বর্ননা করিয়াছেন তাই যথেষ্ট ও সর্বোপরি। যমুনার চব্বিশটি ঘাটে প্রভুর স্নান, বন দেখে প্রেমাবিষ্ট হওয়া, ধেনুগনের প্রভুসঙ্গে চলা, প্রভুকন্ঠ শুনে মৃগীগণের ধেয়ে আসা, বৃক্ষ-লতা প্রভুকে আলিঙ্গন করা, অপ্রকট শুখ-শারীর বৃক্ষ ডালে প্রকট হওয়া, ময়ূরকন্ঠ দেখে প্রভুর কৃষ্ণস্মৃতি হওয়া, রাধাকুন্ড ও শ্যামকুন্ড উদ্ধার, এককথায় প্রেমাবেশে প্রভুর লুপ্ত বৃন্দাবন উদ্ধারের বর্ননা কিরূপে করা সম্ভব? তাই সংক্ষেপে শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর বিরচিত চৈতন্য চরিতামৃতের পাতা থেকে কয়েকটি পংক্তি উদ্ধৃত করিলাম। 

মধুবন তাল কুমুদ বহুল বন গেলা। 
তাঁহা তাঁহা স্নান করি প্রেমাবিষ্ট হইলা।। 
গাভী দেখি স্তব্ধ প্রভু প্রেমের তরঙ্গে। 
বাৎসল্যে গাভী চাটে সব অঙ্গে।। 
প্রভু দেখি বৃন্দাবনে বৃক্ষলতাগন। 
অঙ্কুর পুলক মধু অশ্রু বরিষণ ।। 
প্রতি বৃক্ষ লতা প্রভু করে আলিঙ্গন। 
পুষ্পাদি ধ্যানেতে করেন কৃষ্ণে সমর্পন ।। 
বৃক্ষ ডালে শুখ-শারী দিল দরশন। 
তাহা দেখি প্রভুর কিছু শুনিতে হইল মন ।। 
শুখমুখে শুনি তবে কৃষ্ণের বর্ণন । 
শারিকা পড়য়ে তবে রাধিকা বর্ণন।। 

শুখ বলিলেন -

সৌন্দর্য্যং ললনালিধৈর্য্যদলনং লীলা রমাস্তম্ভিনী। 
বীর্যং কন্দুকিতাদ্রিবর্য্যমমলা: পারে পরার্দ্ধ গুনা: ।। 
বংশীধারী জগ্ননারীচিত্তহারী স শারীকে।
বিহারী গোপনারীভির্জিয়ান্মদনমোহন ।। 

শারী উত্তর দিলেন -

শ্রীরাধিকায়া: প্রিয়তা স্বরূপতা, সুশীলতা নর্ত্তনগানচাতুরি। 
গুণাদিসম্পৎ কবিতা চ রাজতে, জগন্মমোহনচিত্তমোহিনী।। 
রাধা সঙ্গে যদা ভাতি তদা মদনমোহন:।
অন্যথা বিশ্বমোহহপি স্বয়ং মদনমোহিত ।।

নীলাচলে ছিলা যৈছে প্রেমাবেশ মন। 
বৃন্দাবন যাইতে পথ হইল শতগুন ।। 
সহস্রগুন বাড়ে প্রেম মথুরা দর্শনে। 
লক্ষ গুন প্রেম বাড়ে ভ্রমে যবে বনে।। 
অন্য প্রেম উছলে বৃন্দাবন নামে । 
সাক্ষাৎ ভ্রময়ে দেবে সেই বৃন্দাবনে ।। 
এইমত প্রেম যাবৎ ভ্ৰমিলা বার বন। 
একত্রে লিখিলে সব না যায় বর্ণন।। 
জগত ভাসিল চৈতন্যলীলার পাথারে। 
যার যত শক্তি তত পাথারে সাঁতারে ।। 


No comments:

Post a Comment