কলিযুগে সন্ন্যাস নেই - সন্ন্যাসীর কর্ম


 


                প্রথমত, সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি, যদি কোনও শব্দ বা ভাষা কারও মনে আঘাত দেয়। আমার কিছু অভিজ্ঞতা বা কিছু ধর্মীয় গ্রন্থে যা আমি পেয়েছি তা কেবল লেখার চেষ্টা করেছি।

        আদিলেলা, ১৭ তম অধ্যায়শ্রীশ্রী চৈতন্য চরিতামৃত (ব্রহ্মবৈত পুরাণ থেকে প্রাপ্ত) 

অশ্বমেধং গবালম্ভং সন্ন্যাসং পলপিতৃকম। 
দেবরেন সুতৎপত্তিতিং কলৌ পঞ্চ বিবর্জয়েৎ।।  


               
স্পষ্ট করে উল্লেখ করা আছে যে, কোনও যজ্ঞে কোনও ঘোড়া বা গাভী মারা যাবে না, পিতার মৃত্যুর পরে, শ্রাদ্ধে মাংস ব্যবহার চলবে না (হিন্দু ধর্ম অনুসারে মৃত্যুর পরবর্তী ধর্মীয় কাজ), দেবর (স্বামীর ভাই) দ্বারা পুত্র উৎপাদন এবং কলিয়ুগে কোনও তপস্যা বা সন্ন্যাস নেই। কারণ, কলিযুগের মানুষেরা তপস্বী আচরণটি বজায় রাখার মতো শক্তি ধৈর্য থাকবে না, কারণ এটি অত্যন্ত কঠোর এবং শক্ত কাজ। 

 মধ্যলীলাতৃতীয় অধ্যায়শ্রীশ্রী চৈতন্য চরিতামৃত

 প্রভু কহে সন্ন্যাসীর ভক্ষ্য নহে উপকরণ।  
ইহা খেলে কৈছে হবে ইন্দ্রিয় বারণ।। ()
প্রভু বলে এতো অন্ন নারীব খাইতে। 
সন্ন্যাসীর ধৰ্ম নহে উচ্ছিষ্ট রাখিতে।। ()

               এটি বলেছিলেন যখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আদিত্য আচার্যের বাড়িতে প্রসাদ (খাবার) নিয়েছিলেন, তখন মহাপ্রভু বলেছিলেন যে, সন্ন্যাসী খুব বেশি খাবার খাবেন না। অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে লোভ বৃদ্ধি পাবে, যা সন্ন্যাসীর পক্ষে সর্বাগ্রে পরিত্যজ্য প্রয়োজন।

                 আবার সন্ন্যাসী যতটুকু খেতে পারেন, আপনার ততটুকু নেওয়া উচিত, অন্যথায়  খাবারের থালায় বেশি খাবার খাওয়ার অর্থ লোভের সাথে আরও বেশি খাবার গ্রহণ করা, যা কোনও সন্ন্যাসী বা সন্তের পক্ষে সঠিক কর্ম নয়।

                এগুলি ছাড়াও, প্রতিদিন সন্ন্যাসীকে কয়েকটা বাড়ি থেকে তার মুঠো ভাত ভিক্ষা করা উচিত (মুষ্টি ভিক্ষা), এবং রন্ধন  করার পরে তা দিয়ে ঈশ্বরের সেবা দেওয়া এবং তারপরে সেই প্রসাদ গ্রহণ করা উচিত। ভবিষ্যতের জন্য কখনও অতিরিক্ত অন্ন বা ভিক্ষা সংরক্ষণ করা চলবে না।

             মধ্যলীলা, ৭ম অধ্যায়শ্রীশ্রী চৈতন্য চরিতামৃত

 মুকুন্দ হয়েন দুঃখী দেখি সন্ন্যাস ধৰ্ম।  
তিনবার শীতে স্নান ভূমিতে শয়ন।। 

          অর্থাৎ মুকুন্দ মহাপ্রভুর সন্ন্যাসী ধর্ম দেখে দুঃখ পেয়েছিলেন। শীতকালে এমনকি মাটিতে বিছানাতে শয়ন এবং তিনবার স্নান করা।

            সন্ন্যাসী একই জায়গায় তিন ঘণ্টার বেশি সময় থাকেন না। লোকালয় থেকে দূরে নির্জন জায়গায়, মাজারে বা কবরস্থানে সাধারণত দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিদিন কেবলমাত্র একবার অন্ন সেবা (খাওয়া) এবং কেবলমাত্র একটি কাপড় পরিধান   তাদের প্রধান কাজটি কেবলমাত্র ঈশ্বরের নাম প্রচার এবং জপ করা, এর সাথে দুর্দশাগ্রস্ত লোকদের সাহায্য করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকা

এখন প্রশ্ন হল চৈতন্য মহাপ্রভু তাহলে কেন সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন?


চব্বিশ বৎসর শেষ যেই মাঘমাস। 
তাহার শুক্ল পক্ষে প্রভু করিল সন্ন্যাস।। 

              আসলে, তিনি প্রেমের ঈশ্বর (প্রেমের ঠাকুর), তাঁর আবার সন্ন্যাসীর কাজ কী? যিনি স্বয়ং প্রেমের কাঙাল, যার কাছে প্রেমই সার, সদা সর্বদা আনন্দময়, তিনি সব কিছু ছেড়ে সন্ন্যাস গ্রহণ কেন করবেন ? তাঁর অবতারের অন্যতম কারণ ছিল শ্রীমতী রাধা রানীর প্রেম অনুভব করা। তিনি এত কঠিন সন্ন্যাসীর জীবনের সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার কারণ কী ছিল? এর উত্তর - শুধুমাত্র কলিযুগের প্রত্যেকেটি প্রাণীর জীবন বাঁচাতে। অন্যথায়, এই যুগে উদ্ধারের কোনও উপায় নেই। কেবলমাত্র ঈশ্বর শ্রী হরির নাম (হরে কৃষ্ণ) নিলে বা ঈশ্বরের নাম কীর্তন করলেই আমি মানুষকে উদ্ধার করব, তবে তিনি জানতেন যে এই যুগে মানুষের সেইটুক কর্ম করাও সম্ভব হবে না। 

সন্ন্যাসী রূপে যদি করে মোরে নমস্কার। 
তথাপি ঘুচিবে জীবের দুঃখ যে অপার ।।
 
                সুতরাং যদি কেউ আমাকে সন্ন্যাসী রূপে প্রণাম জানায় তাহলেও আমি তাকে উদ্ধার করব। সে কারণেই তাঁর নাম পতিত পাবন। এছাড়া প্রভুর অচিন্তনীয় শক্তি। এমন কি দূর হইতে তাঁহাকে দর্শন করিয়া প্রেমাবেশে কখন কখন জীবগণ হরি বলে বহু তুলে নাচিতে থাকিত। তাই তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া জীবের হৃদয়ে হরিনামরূপ বীজ রোপন করে জীবকে পরিত্রাণ করবেন। এককারন হল ভক্তগনকে ব্রজের নিগূঢ় রস শিক্ষা (রাগ মার্গ ভক্তি বা প্রেমরস নির্যাস)দেবেন, আরেকটি কারন হল যারা নাস্তিক, মায়াবাদী, অভক্ত সেইসব কঠিন জীবকেও উদ্ধার করবেন। 

তুলসী দলমাত্রেণ জলস্য চুলুকেন বা। 
বিক্রীনিতে স্বমাতমাং ভক্ত্যেভ ভক্তবৎসল্য:।। 

                একপত্র তুলসীর সাথে একটু জল দিয়েই যিনি ভগবানকে নিত্য নিবেদন করেন, সেই ভক্তের কাছে ভগবান নিজেকে বিক্রয় করেন। তার ঋণ শোধ করিতে প্রভু সর্বদা সচেষ্ট থাকেন। এহেন দয়াময়, কৃপাময়, প্রেমের ঠাকুর আর  কে আছে ?

 

No comments:

Post a Comment