নিধিবনের রহস্য (বৃন্দাবন)


 


" অধিকারী না হইলে, গোপীর ভজন বুঝবি না,
   
না বুঝে সেই পথে গেলে, কুল কিনারা পাবি না। 
 
নায়ক আর নায়িকার ভাবে, ব্রজরস যে শুনবে গাবে,
তার ইহকাল পরকাল যাবে, নরকে হবে গমন। 
ডাকিতে ডাকিতে যখন, হবে প্রেমের জাগরণ,
প্রেমের ঠাকুর যুগল হয়ে, দেবে তোমায় দরশন। 
গোপীর ভাবের খুলবে দুয়ার, পাবে সেই সেবার অধিকার,
                   
দেহ গেহ হৃদয় তোমার, হবে নিত্য বৃন্দাবন।"                     

                    ‘নিধিশব্দটির অর্থ সম্পদ এবংবনশব্দটির অর্থ অরণ্য। পৃথিবীতে অসংখ্য রহস্যময় স্থান আছে। ভারতবর্ষ, এমন এক তীর্থভূমি যেখানে নানা জাতি অনেক ধর্মের মানুষ একত্রে বসবাস করে। এখানে নানা তীর্থস্থান আছে; যা এখনো রহস্যে ঘেরা। অধুনা উন্নততর বিজ্ঞানের যুগেও এই সকল রহস্যময় স্থান সমূহের পিছনে লুকিয়ে থাকা রহস্যের উন্মোচন সম্ভব হয়নি। যুক্তিবাদী মানব আজও তা যুক্তিতর্কের দ্বারা বিচার করে উঠতে পারেনি। এমনই একটি রহস্যময় স্থান হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমি বৃন্দাবনের নিধিবন। 

                ভক্তি যেখানে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার থেকেও গভীর সেখানে ভক্তরা সমস্ত যুক্তির উর্দ্ধে উঠে তাদের বিশ্বাস ভক্তিকেই প্রাধান্য দেয় বেশী। এরকমই এক উদাহরণ পাওয়া যায় মথুরার বৃন্দাবনে। শহরটি ছোট হলেও এই বৃন্দাবনের খ্যাতি কিন্তু সমগ্র বিশ্ব জুড়ে, শ্রীকৃষ্ণের লীলাকাহিনী মোহিত করে তাঁর ভক্তদের। বৃন্দাবনে রয়েছে তাঁর একটি বিখ্যাত মন্দির 'রংমহল', যা নিধিবন দ্বারা আবৃত। মথুরা জেলার বৃন্দাবনের নিধিবন মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণ পূজিত হন বাঁকে বিহারী রূপে। নিধিকুঞ্জের মন্দিরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভক্তরাঠাকুরজিবলে সম্বোধন করেন নিধিবন হলো বৃন্দাবনের একটি অত্যন্ত পবিত্র রহস্যময় ধর্মীয় স্থান



                     নিধিবনের সমস্ত এলাকাজুড়ে তুলসী গাছ বর্তমান। এই তুলসী গাছগুলির এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। গাছগুলির কান্ড ফাঁপা, ডালপালাগুলি নিচের দিকে ঝুঁকে থাকে শিকড় শুকিয়ে গেলেও সমস্ত গাছ সবুজ পাতায় ছেয়ে থাকে নিধিবনে উপস্থিত তুলসী গাছগুলি যে অত্যন্ত আশ্চর্য, তা অস্বীকার করা যায় না অন্য যে কোনো গাছের অনুরূপ এই গাছগুলির বৃদ্ধি উপরে আকাশের দিকে হয় না, বরং বেশি হয় নিচে ভূমির দিকে। এর সমস্ত ডালপালা বিস্তৃত হয় জমির আশেপাশেই, এটি গাছের সাধারণ প্রকৃতির একেবারেই উল্টো এমনকি এই নিধিবনের সংলগ্ন স্থান ছাড়া অর্থাৎ বৃন্দাবন মথুরার অন্য কোথাও এই প্রজাতির গাছ পাওয়া যায় না। এটা শুধুমাত্র নিধিবনেই বর্তমান

                প্রতিদিন সন্ধ্যার আরতির পর নিধিবনের মূল দ্বার বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি নিধিবনের পশু-পাখিরাও অন্ধকার হতেই নিধিবন পরিত্যাগ করে। এরকমই একটা রীতি প্রচলিত। নিধিবনে কখনো কাউকে রাতে থাকতে দেওয়া হয় না, তবে বলা হয় এমন মানুষও রয়েছেন যারা নিধিবনে সত্যিই শ্রীকৃষ্ণে অবতরণ করেন কিনা তা জানার জন্য রাতে লুকিয়ে থেকেছিলেন পরের দিন সকালে হয় তাঁদের মৃত অবস্থায় নয়তো তাঁরা অপলক দৃষ্টিতে নির্বাক অবস্থায় পাওয়া গেছে, যাদের দু এক দিনের মধ্যে মৃত্যু ঘটেছে

                নিধিবনের মধ্যে সংগীত সম্রাট স্বামী হরিদাস জীর সমাধি আছে, রংমহল, বাঁকে বিহারী মন্দির, বংশী চোর রাধারানী মন্দির, বিশাখা কুন্ড প্রভৃতি দর্শনের স্থান আছে। শোনা যায় রাসলীলা চলাকালীন অষ্টসখীর একজন (বিশাখা) তৃষ্ণার্ত হইলে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বাঁশি দিয়ে একটি জলের কুন্ড তৈরি করেন তার থেকে জল পান করে সখী বিশাখা তৃষ্ণা মেটান তাই কুণ্ডটি বিশাখা কুন্ড নামে পরিচিত

                        রংমহল সম্পর্কে একটি কাহিনী প্রচলিত রয়েছে, বলা হয় এই রংমহল অর্থাৎ রাধা-কৃষ্ণের মন্দিরে রোজ রাতে উপস্থিত হন রাধারানীসহ স্বয়ং কৃষ্ণ। শুধু তাই নয়, তিনি প্রথমে অবতীর্ণ হন নিধিবনে যেখানে তিনি রাধিকা ১৬,১০৮ গোপীর সাথে রাসলীলায় লিপ্ত হন। শোনা যায় নিধিবনের গাছগুলি রাত হলেই গোপীদের রূপ ধারণ করে এবং রাধাকৃষ্ণের উপস্থিতিতে এই অরণ্য অন্যরকম পরিবেশ হয়। আশ্চর্য ব্যাপার নিধিবনে গাছের সংখ্যাও ১৬,১০৮টি যা পুরাণমতে কৃষ্ণের গোপীদের সংখ্যার সমান। ভক্ত পূজারীদের মতে এই লীলার দরুন পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লে বিশ্রামের জন্য স্বয়ং রাধা-কৃষ্ণ উপস্থিত হন রংমহলে, যেখানে তাঁদের জন্য রাখা থাকে মিষ্টি, পান, দাঁতন ইত্যাদি। নিধিবনের দুটো দরজায় লাগানো থাকে মোট আটটি তালা, যেখানে রাত্রে কারোর প্রবেশ নিষেধ। আর মন্দিরের কড়া ব্যবস্থাকে অতিক্রম করে বা অন্য কোনো প্রবেশদ্বারের মাধ্যমে রংমহলের ভিতর প্রবেশ অসম্ভব। কিন্তু প্রত্যহ সকালে মন্দিরের দরজা খুললে দেখা যায় অন্য এক পরিবেশ। শ্রীকৃষ্ণের জন্য চন্দনের খাট, জলের পাত্র, রাধারানীর জন্য শৃঙ্গারের সামগ্রী, প্রসাদ, লাড্ডু, পান ইত্যাদি আগের দিন সন্ধ্যারতির পর রেখে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সেই প্রসাদ অর্ধেক পরিমান, পান চিবোনো এবং দাঁতনগুলিও ব্যবহার করা, সব আসবাবপত্র সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পূজারীরা বিশ্বাস করেন, যে এটা স্বয়ং প্রভুর লীলা ছাড়া অন্য কিছুই নয়

                    এই প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়। আধ্যাত্মিক জগতে যার যেমন ভাব, তার তেমন লাভ। নিধিবনের রহস্য সাধারণভাবে যুক্তি, বুদ্ধি বা বিজ্ঞান দিয়ে বুঝতে যাওয়াটা আমার কাছে নিতান্তই ছেলেমানুষী। মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি গোপীভাব। যা দিয়েই একমাত্র ঈশ্বরের সেবা করা যায়, তাও স্বয়ং রাধারাণীর অনুমতি পাবার পর। বিশ্বের কোটি কোটি ভক্ত সেই ভগবানের একটু সান্নিধ্য লাভ করার জন্য যুগ যুগ ধরে, জনম জনমে সাধনায় রত। আবার সেই কোটি কোটি ভক্তের মধ্যে কদাচিৎ দু-একজন পরম ভক্ত সেই পরম ঈশ্বরকে লাভ করেন। আর সত্যি বলতে, সেই পরম ভক্তের জন্য শুধু নিধিবন নয়, যেখানে-সেখানে বসেই সেই দুর্লভ লীলা দর্শন করেন। দিব্যজ্ঞান, দিব্যচক্ষু, দিব্যদেহ ব্যতীত সাধারণ চর্মচক্ষে নিধিবনে রাসলীলা লুকিয়ে দর্শন বা তার অনুভব এককথায় অসম্ভব। যদি ব্যাপারটা এতো সোজাই হত তাহলে নিধিবন জুড়ে একটা স্টেডিয়াম বানিয়ে দিলেই বা আশেপাশের দোতালা বা তিনতলা বাড়ির জানলা দিয়ে সবাই সেই লীলা দর্শন করতে পারতেন। সাধারণ বিশ্বাসটুকু আমাদের মনে নেই, মঙ্গলময় ঈশ্বর কখনো কারোর ক্ষতি করতে পারেন? তাঁর ভক্ত তাঁকে দর্শনের আশায় যদি নিধিবনে লুকিয়ে থাকেনও সেই ভক্তকে তিনি স্বয়ং মৃত্যুদণ্ড দেবেন? এটাও সম্ভব? তবে শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাখেলা যে নিতান্তই কথার কথা নয় এর পিছনে যে অবশ্যই  রহস্য কারণ রয়েছে তা নিয়ে কোনরকম সন্দেহ নেই। কথাগুলো কারোর অন্তরে আঘাত দিলে অধমকে ক্ষমা করবেন। 

No comments:

Post a Comment