কৈলাশ পর্বত : জ্ঞানগঞ্জ (শাম্বালা)


.

এখানে যে দুটি স্থানের বর্ণনা করা হবেতা ব্যাক্ত করতে যাওয়াটা সত্যি সত্যিই আমার মতো অবোধের পক্ষে নিতান্ত শিশুসুলভ আচরণ মাত্র  

            কারণ এই স্থান সাধারণ মানবের কাছে অগম্যঅবোধ্যঅকল্পনীয়  রহস্যময়।প্রকৃত আধ্যাত্মিক জগতের মানুষের কাছে কিছুটা বোধগম্য এবং উপলব্ধ হতে পারে।যোগীপুরুষমহাপুরুষদের,  সিদ্ধ যোগিনী মাতাজীদের  পীঠস্থানযাঁরা সূক্ষ্ম শরীরে বিচরণ করতে পারে সাধারণ মানুষের কাছে রহস্যময়  অকল্পনীয়তো হবেই।

যাইহোকযতটুকু ক্ষমতা এবং সংগৃহিত করতে পেরেছি তাই ব্যাখ্যা করার নিছক এক প্রচেষ্টা করলাম।

কৈলাশ পর্বত :

                জ্ঞানগঞ্জের কথা বলার আগে কৈলাশ পর্বতের কিছু জানা অজানা তথ্য বলাটা অতন্ত্য জরুরী। কৈলাশ রেঞ্জটি ৩০ মিলিয়ন বছর পুরনো এবং এর সর্বোচ্চ শিখর, ৬৬৭৫ মিটার উঁচু পর্বতটি তার সাদা হিমবাহী ক্রেস্ট দিয়ে চকচকে গ্রানাইট তৈরি, হিমালয় যখন টেথিস সাগর থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছিল তখনও একটি বিশাল কাঠামো ছিল। হিন্দু এবং তিব্বতীরা মনে হয় প্রাচীন কাল থেকেই এই পর্বতের স্বতন্ত্রতা সম্পর্কে সচেতন ছিল। হিন্দুদের কাছে এটি আকাশের প্রভাবশালী পর্বত মেরু, এবং ভগবান শিব এবং তাঁর স্ত্রী দেবী পার্বতীর আবাসনের পার্থিব প্রতিমূর্তি।

                    রহস্যময় এবং অত্যন্ত দুর্গম কৈলাশ পর্বতকে ভগবান মহাদেবের বাসভূমি বলে হিন্দুরা বিশ্বাস করেন বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের কাছেও এই পর্বত অতি পবিত্র স্থান এই পর্বতে একটা নির্দিষ্ট সীমায় যাবার পর আর উপরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। কৈলাশ পর্বত, হিন্দুমতে যা কিনা স্বয়ং ঈশ্বরের বাসভূমি এবং এখান দিয়েই নাকি স্বর্গে আরোহণের পথ। হিন্দুদের কাছে সমস্ত হিমালয় পর্বতমালার মধ্যেই কৈলাশের আকর্ষণ সবথেকে বেশি। রহস্যময় এই পর্বতের আধ্যাত্মিক আকর্ষণের জন্য যুগ যুগ ধরে মানুষ কৈলাশ পর্বতের পদতলে আসেন। রহস্যে ঘেরা দুর্গম এই পর্বত সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত অনেক কিছুই অজানা তিব্বত মালভূমি থেকে ২২,০০০ ফুট ওপরে অবস্থিত কৈলাশ পর্বতের বেশিরভাগটাই এখনও পর্যন্ত রহস্যের অন্ধকারে ঘেরা। হিন্দু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে অতি পবিত্র এই পর্বতের বেশিরভাগ অঞ্চলই অগম্য

                সংস্কৃতে কেলাস (Crystal) শব্দ থেকে কৈলাস কথাটির উৎপত্তি। কারণ সাদা বরফে মোড়া কৈলাসকে দেখে মনে হয় স্ফটিক। তিব্বতি ভাষায় এর নাম গাঙ্গো রিনপোচে। তিব্বতে বৌদ্ধ গুরু পদ্মসম্ভবাকে বলা হয় রিনপোচে। তাঁর থেকেই নামকরণ হয়েছে কৈলাস পর্বতের যার অর্থ হল বরফের তৈরি দামী রত্ন। তিব্বতে প্রচলিত এক প্রাচীন কিংবদন্তি আছেগুরু মিলারেপাই শুধুমাত্র পা রাখতে পেরেছিলেন কৈলাস-শীর্ষে। ফিরে এসে গুরু মানা করেছিলেন এই পর্বত আরোহন করতে। কারণ একমাত্র সে- মানুষই পারবে এর শীর্ষে যেতেযার গায়ে কোনও চামড়া নেই।

 


                    হিন্দু মতে মাউন্ট মেরুর একটি অংশ হল কৈলাশ পর্বত। কৈলাস পর্বতকেই পৃথিবীর ভর কেন্দ্র বলা হয় কৈলাশ পর্বত কসমিক অ্যাক্সিস বা ওয়ার্ল্ড পিলার নামেও পরিচিত। কৈলাশ পর্বতের শীর্ষে ওঠার জন্য আগে কয়েকজন পর্বতারোহী চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কেউই তা শেষ করে উঠতে পারে নি। প্রায় পিরামিডের আকারের এই পর্বতে অনেক প্রাচীন গুম্ফা গুহা রয়েছে। সেখানে দেখা যেতে পারে বৌদ্ধ হিন্দু সন্ন্যাসীদের। এই সন্ন্যাসীরা লোকসমাজের আড়ালে বহু বছর ধরে তপস্যা করে চলেছেন। প্রতি বছর হাজার হাজার তীর্থযাত্রী মানস সরোবর দর্শন করেন। তবে অত্যন্ত দুর্গম প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে অল্প কয়েকজনই যাত্রা সম্পূর্ণ করতে পারেন। 

                গ্যাঙ্গডিস পর্বতের চূড়া যা তিব্বতের হিমালয় পর্বতমালার একটি অংশ। এটি এশিয়ার বৃহৎ সিন্ধু নদী, শতদ্রু নদী, ব্রহ্মপুত্র নদ প্রভৃতি নদীগুলোর উৎস স্থান। একে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন এবং বন ধর্ম - এই চার ধর্মের তীর্থস্থান হিসেবে ভাবা হয়। কৈলাস পর্বতের পাদদেশে মানস সরোবর এবং রাক্ষসতাল অবস্থিত।

                    মানস সরোবর ছাড়াও কৈলাশ পর্বতের পাদদেশে রয়েছে আরও একটি অতি সুন্দর হৃদ রাক্ষস তাল। ১৪,৯৫০ ফুট ওপরে, মানস সরোবর বিশ্বের উচ্চতম মিষ্টি জলের হৃদ। আরও একটি আশ্চর্যের বিষয় যত জোরেই হাওয়া থাকুক, মানস সরোবরের জল সর্বদা শান্ত, কিন্তু রাক্ষসতালের জল সর্বদা অশান্ত থাকে। ভগবান শিবকে প্রসন্ন করার জন্য রাক্ষসরাজ রাবণ যে কঠিন তপস্যা করেছিলেন, তার থেকেই রাক্ষসতালের সৃষ্টি বলে ধরা হয়। এই কারণেই এই হৃদের জল অশান্ত। তাছাড়া এই হৃদের জল নোনতা এবং এখানে জলজ উদ্ভিদ এবং জলজ প্রাণী দেখা যায় না।

                    কৈলাশ পর্বতেই স্বর্গ এসে পৃথিবীতে মিশেছে বলে বিশ্বাস কৈলাস পর্বতের আবহাওয়ায় এমন কিছু অদৃশ্য শক্তি আছে যাতে নাকি মানুষের চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ দ্রুত ফুটে ওঠে। সাধারণভাবে মানুষের নখ-চুল যে হারে বর্ধিত হয়কৈলাস পর্বতে অন্তত ১২ ঘণ্টা কাটালে নাকি এই বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ হয়ে যায়। কথিত আছে, একবার কয়েকজন সাইবেরিয়ান পর্বতারোহী কৈলাশ পর্বতের নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশ করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই তাদের বয়স কয়েক দশক বেড়ে যায় এবং এর কয়েক বছর পরেই বার্ধক্যজনিত কারণে তাঁদের মৃত্যু হয়

জ্ঞানগঞ্জ (শাম্বালা):

                জ্ঞানগঞ্জ  (তিব্বতি ভাষায় শাম্বালাযেহেতু স্থানটিতে যাওয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে  অসম্ভব, তাই তার সম্বন্ধে বর্ণনা দেওয়া একমাত্র মহাপুরুষদের, নাগা মাতাজীদের বা সিদ্ধ যোগীপুরুষদের মুখ নিঃসৃত কিছু কথা বা দীর্ঘদিন ধরে যারা এই স্থানটিকে নিয়ে গবেষণা করছেন তাদের অনুভব থেকে সংগৃহীত করেই আলোচনা করা হচ্ছে মাত্র।  এই বিশ্বের ২০-২৫% কি তার থেকেও কম সংখ্যক মানুষ জ্ঞানগঞ্জের নাম শুনেছেন, বাকি ৭৫-৮০% মানুষ নামই শোনেননি। হিমালয় পৃথিবীর এক সুন্দরতম স্থান, যা প্রায় ২৫০০ কিমি জুড়ে অবস্থিত। এই হিমালয় সিদ্ধিলাভের এক আদর্শ পীঠস্থান এবং এর অন্তঃপুরে কত অজানা রহস্য আজও লুকিয়ে আছে, তা কেইবা বলতে পারবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রহস্যে মোড়া হিমালয় অনাদিকাল থেকেই বিশ্বের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তেমনি এক রহস্যময় স্থান জ্ঞানগঞ্জ, যা না দেখা যায়, না যাওয়া যায়, এমনকি কোনো স্যাটালাইট থেকে যার কোন অস্তিত্ব ধরা পরে না। 

                      তিব্বত বিশ্বের অন্যতম সুন্দর, পবিত্র এবং পরিষ্কার স্থান। এই প্রত্যন্ত অঞ্চলটি কেবল শিহরন খোঁজা - সন্ধানকারীদেরই জন্যই নয়, তাঁদেরও জন্য যারা তাদের জীবনের গভীর অর্থ খুঁজছেন। তিব্বত এখনও বেশিরভাগ অজানা এবং অনাবৃত, এটি গত শতাব্দী অবধি রহস্য এবং প্রত্যন্ত অবস্থায় কাটছে। এই হিমালয় অঞ্চলের সাথে সংযুক্ত অসংখ্য পৌরাণিক কাহিনী কিংবদন্তি এর আকর্ষণকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

                    জ্ঞানগঞ্জ, অমরত্বের ভূমি, হিমালয়ের রহস্যময় উপত্যকাগুলির কোথাও এক স্থানে ২১ কিমি জুড়ে অবস্থিত। জ্ঞানগঞ্জকে বলা হয় রহস্যময় অমর মহাপুরুষদের বাস করা একটি নগর-রাজ্য, যারা প্রয়োজন হলে সূক্ষ্ম দেহে মানুষের অস্তিত্বকে প্রভাবিত করে। মানসিক প্রতিবন্ধকতা এবং মাত্রা (চতুর্থ  আয়াম) উপেক্ষা করে কেবলমাত্র মহাপুরুষ সাধুগণই এই আধ্যাত্মিক ভূমিতে স্থান পাবে, যাদের কোনো খারাপ কর্ম নেই। এই কিংবদন্তি রাজ্যের সঠিক অবস্থানটি অজানা কারণ জ্ঞানগঞ্জ চতুরভাবে মানুষ এবং ম্যাপিং প্রযুক্তি (চতুর্থ আয়াম-) থেকে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে বলে মনে করা হয়। কিছু মানুষ এটিও ধরে নিয়েছে যে, জ্ঞানগঞ্জ পৃথক অস্তিত্বের জায়গায় বাস করে এবং তাই উপগ্রহের কাছেও এটি অদৃশ্য। কথিত আছে, প্রয়োজনের সময় এই জায়গাটি নিজেই নিজের অবস্থান বা রঙ পরিবর্তন করে বা অন্য কোথাও স্থানান্তরিত হয়  জ্ঞানগঞ্জের সারা বিশ্বব্যাপী অনেক শাখা জ্ঞানগঞ্জ আছে, সেগুলি কোথাও গভীর অরণ্যে, কোথাও নদী গর্ভে, বা কোনো পাহাড়-পর্বতের নির্জন স্থানে অবস্থিত।

                 এমন নয় যে সব জ্ঞানগঞ্জ সর্বদা লোকচক্ষুর আড়ালে অবস্থান করে। অনেক মন্দির, মঠেও জ্ঞানগঞ্জের কর্ম কাণ্ড আজোও বর্তমান বহু সাধক, মুনি, ঋষি, যোগী, যারা জ্ঞানগঞ্জ থেকে এসে মানব কল্যানের জন্য অনেক কর্ম করেছেন এবং হিতকারি উপদেশ দিয়েছেন বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী, রামদাস কাঠিয়া বাবা, ত্রৈলঙ্গ স্বামী, বহু নাগা সন্ন্যাসী সন্ন্যাসিনী, শ্রী শ্রী রামঠাকুর,  গন্ধ বাবা, শ্যামাচরণ লাহিড়ী এবং আরো অনেকে। সেই স্থানে (জ্ঞানগঞ্জ) যেহেতু কালচক্র কাজ করে না, তাই কারোর বয়স বৃদ্ধি হয় না।  কেউ ২০০ বছর, কেউ ৫০০ বছর, কেউ বা ২০০০ বছর আবার কেউ বা ৫০০০ বছর, একইরকম ভাবে ধ্যান সাধনায় নিমগ্ন। কথিত আছে, জ্ঞানগঞ্জের প্রধান মহাতপা মহামুনি সত্য যুগ থেকে আজও (কয়েক লক্ষ বছর ধরে) একইরকম বর্তমান। 

                এখন কথা হল জ্ঞানগঞ্জএর আসল কর্ম কি? পার্থিব জগতের বিজ্ঞান বলতে আমরা বুঝি পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান এবং জীবন বিজ্ঞান কিন্তু এই বিজ্ঞান ওই জগতে কোন কাজে আসে না সেই অপার্থিব জগতে যে চর্চা হয় তা সূর্য বিজ্ঞান (তেজ), চন্দ্র বিজ্ঞান (শান্তি), বায়ু বিজ্ঞান (শক্তি), সৌর বিজ্ঞান প্রভৃতি তৎসহ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুত, ব্যোম বা আকাশএই নিয়ে গভেষনা চলে শক্তি এবং পাঁচটি তত্ত্বের বিকার।  যেমন সেই স্থানে রন্ধনের জন্য গ্যাস, কাঠ, বা কোনো চুল্লীর প্রয়োজন নেই। অদৃশ্য শক্তিকে কাজে লাগানো হয় যা সাধারণ মানুষের কাছে ম্যাজিক।  এই সমস্ত কিছু বিশ্ব তথা মানব কল্যানের কাজে ব্যবহার করা হয় এক কথায় জ্ঞানগঞ্জ হল এই বিশ্বের নিয়ন্ত্রক কেন্দ্র

                    তিব্বতীয় বৌদ্ধদের বিশ্বাস পৃথিবীর যখন ধ্বংসের সময় আসবে, জ্ঞানগঞ্জ-এর ২৫তম শাসক এই সুন্দর পৃথিবীকে বাঁচাবে। ঔপন্যাসিক জেমস হিল্টন শাম্ভালার উপর তার বিখ্যাত বই লিখেছিলেন - "Lost Horizon : The Legend of Shangri-La " এছাড়া হাঙ্গেরির গবেষক সিসোমা ডি কোরাস ১৮৩৩ সালে জ্ঞানগঞ্জকে নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন এবং দীর্ঘদিন তিব্বতে থেকেও কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন নি। তিনি বলেছিলেন এই মায়াবী নগরটি নিজে থেকে ধরা দিতে চায় না। এরপরেও সারা বিশ্বের অনেক লেখক, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, ধর্মীয় ভাবাপন্ন ব্যক্তি, দার্শনিকেরা, প্রত্নতাত্ত্বিক গন এর খোঁজে আসলেও কিছু বিশেষ অনুভব ছাড়া সবাই প্রায় বিফল হয়েই ফিরে গেছেন।

No comments:

Post a Comment