অদ্বৈত গৃহে অধিবাস-মহোৎসব


 


গেরুয়া বসন, অঙ্গেতে পরিব,
শঙ্খের কুন্ডল পরি। 
যোগিনীর বেশে, যাব সেই দেশে,
যেথায় নিঠুর হরি।  

                    মহাপ্রভু দীক্ষা মন্ত্র নিয়েছিলেন ঈশ্বর পুরীর নিকট হইতে এবং সন্ন্যাস মন্ত্র গ্রহণ করেছিলেন কেশব ভারতীর কাছ হইতে। প্রথমে ভারতী গোসাঁই অমত করলেও পরে তিঁনি নিমাইকে সন্ন্যাস মন্ত্র দিতে রাজি হন। তবে ভারতী গোসাঁই জানতেন নিমাই স্বয়ং ঈশ্বর। তাই তিঁনি শর্ত রাখলেন - আমি যদি তোমায় মন্ত্র দান করি - তুমি আমায় গুরু বলিবে, তাহাতে আমি অপরাধী হব। অতএব আমি যদি তোমার গুরু হই তবে তোমাকে কথা দিতে হবে তুমিও আমার ভব সাগরের কান্ডারী হবে। 
            কিন্তু স্বয়ং জগদ্বীশ্বরকে কি মন্ত্র প্রদান করিবেন? ভারতী গোসাঁইর মনের ভাব বুঝতে পেরে নিমাই বলিলেন, স্বপ্নযোগে যে মন্ত্র আমি পেয়েছি, ঐ মন্ত্রটি শুনে আমার কর্ণে ফিরিয়ে দিন। সন্ন্যাস গ্রহণের পর নব জন্ম লাভ হয় এবং নতুন নাম প্রাপ্ত হয়। ভারতী গোসাঁই নিমাইয়ের বুকে হাত রেখে বলিলেন, "নিমাই! তুমি জীবমাত্রকে শ্রীকৃষ্ণে চৈতন্য করাইলে, অতএব আজ হইতে তোমার নাম হইল - শ্রীকৃষ্ণ-চৈতন্য"। সন্ন্যাস গ্রহণের পর প্রভুর মুখে একই বাক্য - আমি বৃন্দাবন যাব। ব্রজে গেলে আমি কৃষ্ণ পাব। প্রায় বাহ্যজ্ঞানহীন অবস্থায় কখনো সজোরে হেঁটে চলেছেন, আবার কখনো দৌড়াইতেছেন। 

সন্ন্যাস করিয়া প্রেমাবেশে চলে বৃন্দাবন। 
রাঢ় দেশে তিনদিন করিলা ভ্রমন ।।
(রাঢ় দেশ - গঙ্গার পশ্চিম পারস্থ নবদ্বীপের পাশে অধুনা কালনা-কাটোয়া নামে পরিচিত।) 

                    আশ্চর্য্য ব্যাপার তিনদিন প্রভু রাঢ় দেশে ভ্রমন করিতেছেন অথচ বৃন্দাবনের দিকে অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না। প্রথম দিনে যেস্থানে ছিলেন, তিনদিন পর প্রায় সেই স্থানেই অবস্থান করছেন। অথচ তিন দিবস-রজনী কেবল হাঁটিয়াছেন, আর প্রথমদিন কেবল দৌঁড়াইয়াছিলেন। এর কারণ কি? কারণ হল - মা শচী "নিমাই নিমাই" বলিয়া কাঁদিতেছেন, বিষ্ণুপ্রিয়া "মদনমোহন" বলিয়া ডাকিতেছেন, ভক্তগণ "প্রভু" বলিয়া চিৎকার করিতেছেন। এই সমস্ত আকর্ষণ ও রোদন সূক্ষ্ম রজ্জুরূপে প্রেমফাঁস স্বরূপ তাঁহাকে পশ্চাতে টানিতেছে। তাই প্রায় অচেতন অবস্থায় ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াইতেছেন, বৃন্দাবনের দিকে অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না। তবে অসীম শক্তিসম্পন্ন বলিয়া অবশেষে এই সমুদায় রজ্জু ছিঁড়িতে সক্ষম হইয়াছিলেন। আর এই তিনদিন প্রভু অনবরত চলিয়াছিলেন, জলস্পর্শ পর্যন্ত্য করেন নাই। 
                    এই অবধি পর্যন্ত নিত্যানন্দ প্রভু, আচার্য্য রত্ন ও মুকুন্দ তিন জন মহাপ্রভুর সহিত চলিতেছেন। মহাপ্রভু তা জানিতেন না। নিত্যানন্দ প্রভু সেখানে উপস্থিত বালকগণকে শিখাইয়া দিলেন যদি প্রভু বৃন্দাবনের পথ জিজ্ঞেস করে তবে তোমরা গঙ্গা তীর পথ দেখাইয়া দিবা। বালকগণ সেইরূপ প্রভুকে গঙ্গা তীর পথ দেখাইয়া দিল। তখন প্রভুর সাময়িক জ্ঞানের উদ্ভব হল এবং নিত্যানন্দ প্রভুও মহাপ্রভুর সামনে দর্শন দিলেন। 

প্রভু কহে শ্রীপাদ তোমার কোথাকে গমন।
শ্রীপাদ কহে তোমা সঙ্গে যাব বৃন্দাবন ।।
প্রভু কহে কতদূর আছে বৃন্দাবন ।
তিহ কহেন কর এই যমুনা দর্শন ।।
এত বলি আনিলা তাঁরে গঙ্গা সন্নিধানে ।
আবেশে প্রভুর হইল গঙ্গায় যমুনা জ্ঞানে ।।

                        ইতিমধ্যে নিত্যানন্দের কথামত অদ্বৈত আচার্য্য নৌকা ও নতুন কৌপিন বাহির্বাস লইয়া গঙ্গার তীরে অবস্থান রত। অদ্বৈত আচার্য্যকে দর্শনমাত্র মহাপ্রভুর মনে সংশয়ের উদয় হইল। 

তুমিতো আচার্য্য গোসাঁই এথা কেনে আইলা। 
আমি বৃন্দাবনে তুমি কেমতে জানিলা ।। 
আচার্য্য কহে তুমি যাঁহা সেই বৃন্দাবন। 
মোর ভাগ্যে গঙ্গাতীরে তোমা আগমন।। 
প্রভু কহে নিত্যানন্দ আমারে বঞ্চিলা। 
গঙ্গাকে আনিয়া মোর যমুনা কহিলা।। 
আচার্য্য কহে মিথ্যা নহে শ্রীপাদ বচন। 
যমুনাতে স্নান তুমি করিলা এখন।। 
গঙ্গায় যমুনা বহে হইয়া একধার। 
পশ্চিমে যমুনা বহে, পূর্বে গঙ্গাধার।।
প্রেমাবেশে চারিদিন আছ উপবাস।
আজি মোর ঘরে ভিক্ষা চল মোর বাস।।  

                        প্রভুর সেবার কত শত যে উপকরণ পাক করেছিলেন সীতা ঠাকুরানী (আচার্য্য পত্নী) তা বর্ননা করার মতন না। কি নেই তাতে - বিশদ ব্যাখ্যা শ্রী শ্রী চৈতন্য-চরিতামৃতের মধ্যলীলার তৃতীয় পরিচ্ছেদে বর্ণিত আছে। সেথায় মাতা শচী সহ নদীয়া নগরে লোক, স্ত্রী, বৃদ্ধ, বালক সকলেই আসিয়া প্রভুকে দর্শন করিলেন।বেশ কিছুদিন থাকার পর যখন প্রভু চলে যেতে চাইলেন, তখন অদ্বৈত প্রভু আর কিছুদিন যাপন করার অনুরোধ করলেন।

তবেত আচার্য্য কহে বিনয় করিয়া।
দিন দুই চারি রহ কৃপা ত করিয়া ।।
আচার্য্যের বাক্য প্রভু না করে লঙ্ঘন।
রহিলা অদ্বৈত গৃহে না করে গমন ।।
আনন্দিত হৈলা আচার্য্য শচী ভক্ত সব ।
প্রতিদিন করে আচার্য্য মহা-মহোৎসব ।।
দিনে কৃষ্ণরস কথা ভক্তগন সঙ্গে ।
রাত্রে মহা-মহোৎসব সংকীর্তন রঙ্গে ।।
আনন্দিত হইয়া শচী করেন রন্ধন। 
সুখে ভোজন করে প্রভু লইয়া ভক্তগন ।।
অদ্বৈত গৃহে প্রভু বিলাস শুনে যেই জন। 
অচিরে মিলয়ে তারে কৃষ্ণ প্রেমধন ।। 



অধিবাস কীর্ত্তন

একদিন পহুঁ আসি, অদ্বৈত মন্দিরে বসি
বলিলেন শচীর কুমার
নিত্যানন্দ করি সঙ্গে, অদ্বৈত বসিয়া রঙ্গে
মহোৎসবের করিলা বিচার
শুনিয়া আনন্দে আসি, সীতা ঠাকুরাণী হাসি
বলিলেন মধুর বচন
তা শুনি আনন্দ মনে মহোৎসবের বিধানে
বলে কিছু শচীর নন্দন।
শুন ঠাকুরাণী সীতা, বৈষ্ণব আনিয়া হেথা
আমন্ত্রন করিয়া যতনে
যে- বা গায় যে বাজায়, আমন্ত্রন করি তায়
পৃথক পৃথক জনে জনে
এই বলি গৌরা রায়, আজ্ঞা দিল সবাকায়
বৈষ্ণব করহ আমন্ত্রনে
খোল করতাল লৈয়া, অগুরু চন্দন দিয়া
পূর্ণঘট করহ স্থাপনে
আরোপন করি কলা তাহে বাঁধ ফুলমালা
কীর্তন মন্ডলী কুতুহলে
মালা চন্দন গুয়া, ঘৃত মধু দধি দিয়া
খোল মঙ্গল সন্ধাকালে
শুনিয়া প্রভুর কথা, প্রীতে বিধি কৈল যথা
নানা উপহার গন্ধ বাসে।

নানা দ্রব্য আয়োজন, করি করে নিমন্ত্রন
কৃপা করি কর আগমন
তোমরা বৈষ্ণবগন, মোর এই নিবেদন
দৃষ্টি করি কর সমাপন
এত করি নিবেদন, আনিল মহান্তগন
কীর্তনের করি অধিবাস
অনেক ভাগ্যের ফলে, বৈষ্ণব আসিয়া মিলে
কালি হবে মহোৎসব বিলাস
আগে রম্ভা আরোপন পূর্ণ ঘট স্থাপন
আম্র পল্লব সারি সারি
দ্বিজ বেদ ধ্বনি করে, নারীগণ জয় জয় করে
আর সবে বলে হরি হরি
দধি ঘৃত মঙ্গল, করি সবে উতরোল
করয়ে আনন্দ প্রকাশ
আনিয়া বৈষ্ণবগন, দিয়া মালা চন্দন
কীর্ত্তন মঙ্গল অধিবাস
সবার আনন্দমন, বৈষ্ণবের আগমন
কালি হবে চৈতন্য কীর্ত্তন
গৌরাঙ্গ আদেশ পাঞা, ঠাকুর অদ্বৈত যাঞা
করে খোল মঙ্গলের সাজ
আসিয়া বৈষ্ণব সব, হরিবোল কলরব
মহোৎসবের করে অধিবাস
আপনি নিতাই ধন, দেই মালা চন্দন
করে প্রিয় বৈষ্ণব সম্ভাষ
গোবিন্দ মৃদঙ্গ লৈয়া, বাজায় তা তা থৈয়া থৈয়া
করতালে অদ্বৈত চপল
হরিদাস করে গান, শ্রীবাস ধরয়ে তান
নাচে গোরা কীর্ত্তন মঙ্গল
চৌদিকে বৈষ্ণব গন, হরি বলে ঘন ঘন
কালি হবে কীর্ত্তন মহোৎসব
আজি খোল মঙ্গলি, রাখিয়ে আনন্দ করি
বংশী বলে দেহ জয় রব।



No comments:

Post a Comment